একবার ঢাকা যেতে প্রকল্প কর্মকর্তার ভ্রমণ ব্যয় ৬০ হাজার, গাড়ির খরচ মাসে ৭৫ হাজার
বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্র আধুনিকায়নে ৪৯ কোটি ৮৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) করা হলেও এখনও কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এই প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অংকের বরাদ্দ পাওয়া আবাসিক ভবনের কাজ তিন বছরে তেমন আলোর মুখ দেখেনি। এখনও পর্যন্ত শেষ হয়েছে ৪১৪টি পাইলিংয়ের কাজ। এছাড়া ভ্রমণ ব্যয়ে মোট বরাদ্দ হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ হওয়া এই প্রকল্পের শেষ সময় ২০২৩-২৪ অর্থবছর। এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না হলে বরাদ্দ ফেরত যাবে। ২০২২-২৩ পর্যন্ত দুই অর্থ বছরে প্রকল্পের ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছে আরও ৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া টাকার সঠিক ব্যবহার হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, অনাবাসিক ভবনের কাজ শেষের জন্য আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনে করেছেন তিনি। ভবন হলেই যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, আসবাবপত্র কেনা হবে।
প্রকল্পের ধীরগতির কারণ হিসেবে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার ঘাটতি এবং পাইলিং করা জায়গায় আগে থেকে বেসমেন্টের কথা জানান। ফলে পাইলিং করার আগে এসব বেসমেন্টের অংশ তুলে পরে কাজ করতে হয়েছে, যাতে সময়ক্ষেপণও হয়েছে।
এছাড়া দুই অর্থবছরে ভ্রমণ ব্যয় না দেখালেও এই অর্থবছরে সাড়ে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দের বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি মিটিংয়ে যোগ দিতে ঢাকায় যেতে বিমানভাড়াসহ তার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়।
ডিপিপি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আধুনিকায়নে পাঁচ তলা ভবন, ডিজিটাল সম্প্রচারে যন্ত্রপাতি স্থাপন, আসবাবপত্র ক্রয়, অফিস স্টাফদের বেতন, ভ্রমণ ভাতা, কম্পিউটার সামগ্রী ক্রয় খাতের কথা।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৯ কোটি ৮৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল সম্প্রচার যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ হয়েছে অনাবাসিক ভবন নির্মাণ খাতে। ডিপিপি অনুযায়ী এ খাতে মোট বরাদ্দ হয়েছে ২৯ কোটি ৯৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা। জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
প্রকল্প প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী সম্মানি ভাতায় মোট বরাদ্দ রয়েছে ১০ লাখ টাকা। মোট বরাদ্দ থেকে প্রকল্পের অগ্রগতি দেখে প্রতি অর্থবছরের থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। জুন ২০২৩ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। নতুন করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ হয়েছে ৪ লাখ টাকা।
প্রজেক্ট ইমপ্লিমেনটেশন কমিটি (পিআইসি) ও স্টিয়ারিং কমিটির মিটিংয়ে সদস্যদের সম্মানি বাবদ এই ভাতা ব্যয় করা হয়। এসব মিটিং মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমাসে গড়ে দুটো করে মিটিং থাকে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আসিফুর রহমান। প্রতি মিটিংয়ে সম্মানি হিসেবে স্টিয়ারিং কমিরি সদস্যদের ৩ হাজার টাকা ও পিআইসি কমিটির সদস্যদের ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
আপ্যায়ন ব্যয়ে ডিপিপি অনুযায়ী বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ টাকা। তবে জুন ২০২৩ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৯ হাজার। ২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ হয়েছে ৬৮ হাজার টাকা।
প্রকল্প চলাকালীন সময় হায়ারিং চার্জ বা গাড়ি ভাড়া খাতে ডিপিপি অনুযায়ী বরাদ্দ রয়েছে ২৭ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ১২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ হয়েছে আরও ৯ লাখ টাকা। হায়ারিং চার্জ বা গাড়ি ভাড়ার খরচ হিসেবে প্রকল্প কর্মকর্তার গাড়িতে মাসে ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দের মধ্যে তেল, ড্রাইভারের বেতন ও মেনটেইন্যান্স খাতে ব্যয় হয়।
আউটসোর্সিং বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ১৪ লাখ টাকা। জুন ২০২৩ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে ৫ লাখ ৪ হাজার টাকা।
এ প্রকল্পের আওতায় দু’জন আউটসোর্সিং কর্মচারী রয়েছেন। এদের এক জন অফিস সহকারী এবং অপরজন অফিস সহায়ক, দু’জনের বেতন ৪০ হাজার টাকা। প্রকল্পর মূল কাজ শুরু না হওয়ায় তাদের অন্য কোনো কাজ নেই। সকাল-বিকাল পাইলিংয়ের কাজ দেখে রিপোর্ট দেয়—এমন তথ্য জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তা নিজেই।
ভ্রমণ ব্যয় খাত নিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আসিফুর রহমান জানান, পিআইসি ও স্টিয়ারিং কমিটির মিটিংয়ে তাকে ঢাকার মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়। প্রতিমাসে গড়ে দুটো করে মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে অংশ নিতে হয়। প্রতিবার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিমানভাড়া লাগে ভ্রমণ খরচ হিসেবে।
ভ্রমণ খাতে প্রকল্পের মোট বরাদ্দ রয়েছে ১৫ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভ্রমণ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কোনো ভ্রমণ খরচ দেখানো হয়নি প্রতিবেদনে।
প্রকল্পে কম্পিউটার সামগ্রী বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৩ লাখ টাকা। জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যয় বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আসিফুর রহমান জানান, কম্পিউটারের কালি কিনতে এই টাকা খরচ হচ্ছে।
এছাড়া কম্পিউটার ও আনুসঙ্গিক খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৮ লাখ টাকা। জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ টাকা।
আসবাবপত্রে মোট বরাদ্দ রয়েছে ১২ লাখ ৩ হাজার টাকা। জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে দুটি টেবিল, দুটি চেয়ার, ৫ সিটের সোফা, ছোট চেয়ার ১০টি এবং কম্পিউটার চেয়ার ১টি।
প্রকল্প পরিচালক মো. আসিফুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্প সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। আমি বেতারে আঞ্চলিক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর আমাকে কিছুদিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আসলে যে জায়গায় ভবনটি করা হচ্ছে, সেখানে আগে স্থাপনা ছিল। ছয়টি স্থাপনা অপসারণ করতে পারে। ট্রান্সমিটারের ফিডার কেবল লে-আউট পুরোটাই বাইরে নিতে হয়েছে। ৫০ কেভির বৈদ্যুতিক লাইন সরাতে হয়েছে। ভবনটি করতে গিয়ে মাটি খুঁড়তে গিয়ে দেখা গেছে, নিচে বেসমেন্ট করা। সেগুলো তুলে নতুন করে পাইলিং করতেই প্রকল্পের সময় চলে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২৫ সাল পর্যন্ত বর্ধিত সময় চেয়েছি। সময় বাড়ানো হলে ভবন তৈরির পর বৈদ্যুতিক, বেতার সরঞ্জাম, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি কেনা হবে। বৈদ্যুতিক স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। আগে যন্ত্রপাতি কিনে রাখলে ওয়ারেন্টির মেয়াদ চলে যাবে। আর যদি ভবন তৈরি প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদেও না হয় টাকা ফেরত যাবে। তখন আমাদের করার কিছুই থাকবে না।’